Monday, December 6

পুঁজিবাজারে ইউনিক হোটেলের অতিরঞ্জিত তথ্য

Alo (December 06, 2010)

দেশের পাঁচতারা হোটেল ওয়েস্টিনের স্বত্বাধিকারী প্রতিষ্ঠান ইউনিক হোটেল অ্যান্ড রিসোর্টস লিমিটেড অতিরঞ্জিত তথ্য দেখিয়ে পুঁজিবাজার থেকে ৫৫৫ কোটি টাকা উত্তোলন করতে চায়।
কোম্পানির ১০ টাকার শেয়ারের দাম ধরা হয়েছে ১৮৫ টাকা, এর ১৭৫ টাকাই প্রিমিয়াম। কিন্তু কোম্পানির মৌলিক ভিত্তি ও ভবিষ্যৎ আয় এই উচ্চমূল্যকে সমর্থন করে না বলে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা মনে করছেন।
যে তিনটি প্রকল্প তৈরির জন্য পুঁজিবাজার থেকে এই অর্থ উত্তোলন করা হবে, তার একটি নির্মাণাধীন এবং বাকিগুলো এখনো রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে অনুমোদনই পায়নি।
আর্থিক বিবরণীতে ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের (ডিএসই) তালিকাভুক্তি কমিটিও অনেকগুলো অসংগতি পেয়েছে। যেমন নগদ সম্পদের খাতে অন্যান্য প্রাপ্তিযোগ্য আয় ৬৭ কোটি টাকা বলা হলেও এ সম্পর্কে বিস্তারিত কোনো তথ্য নেই। হিসাব নিরীক্ষণের অনেক মানদণ্ড অনুসরণ করেও আর্থিক বিবরণী তৈরি করা হয়নি। ডিএসইর তালিকাভুক্ত কমিটি লিখিত মতামত বোর্ডের কাছে পাঠিয়ে দিয়েছে। পুঁজিবাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থা সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (এসইসি) বর্তমানে তাদের বিবরণপত্র বা প্রসপেক্টাস পরীক্ষা-নিরীক্ষা করছে।
কোম্পানিটির পক্ষ থেকে দাবি করা হয়েছে, তাদের দাবি করা মূল্য সম্পদের বর্তমান ও ভবিষ্যৎ মূল্যের যুক্তিযুক্ত প্রতিফলন। তিনটি নতুন হোটেলের মধ্যে বর্তমানে লি মেরিডিয়ান নির্মাণাধীন। বাকিগুলোর জমির বন্দোবস্ত আছে। রাজউকের অনুমোদন পেলে আগামী বছরই কাজ শুরু করা যাবে।
কোম্পানির একমাত্র হোটেল ওয়েস্টিন বাণিজ্যিকভাবে চালু হয় ২০০৭ সালে। ওই বছর কোম্পানির শেয়ারপ্রতি আয় ছিল ২২ পয়সা, ২০০৮ সালে ৫৪ পয়সা এবং ২০০৯ সালে আয় ছিল দুই টাকা ছয় পয়সা। চলতি বছরের ছয় মাসে কোম্পানির ১০ টাকার শেয়ারে আয় দেখানো হয়েছে তিন টাকা। কিন্তু এরও একটা বড় অংশ এসেছে মূল ব্যবসা থেকে নয়, শেয়ার কেনাবেচা করে।
ডিএসইর সাবেক প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফাইন্যান্স বিভাগের অধ্যাপক সালাহউদ্দিন আহমেদ খান বলেন, ১০ টাকার শেয়ারে বছরে দুই থেকে তিন টাকা আয় করতে একজন বিনিয়োগকারীকে প্রাথমিক শেয়ারের জন্য ১৮৫ টাকা দিতে হবে। শেয়ার বিতরণ হওয়ার পর কোম্পানির দাম-আয় অনুপাত হবে ১১৮। এই দামে শেয়ারে বিনিয়োগ খুবই ঝুঁকিপূর্ণ হবে।
এদিকে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ডিএসইর পরিচালনা পর্ষদের একজন প্রভাবশালী সদস্য অতি উচ্চমূল্যে ইউনিক হোটেল অ্যান্ড রিসোর্টস লিমিটেডকে তালিকাভুক্ত করার জন্য কাজ করছেন। তিনি বিভিন্ন সদস্যের কাছে ১৬০ টাকা দরে কোম্পানি প্রাইভেট প্লেসমেন্টে শেয়ার রাখার জন্য তদবির করছেন। ডিএসইর পরিচালনা পর্ষদে এ নিয়ে একজন সদস্যের সঙ্গে তর্কবিতর্কও হয়। কিন্তু পরবর্তী সময়ে বোর্ড কোনো সিদ্ধান্ত না দিয়ে তালিকাভুক্তি কমিটির মতামতসহ এসইসিতে পাঠিয়ে দিয়েছে।
জানা গেছে, প্রাথমিক শেয়ারের জন্য যে প্রস্তাব করেছে কোম্পানিটি, তার চেয়ে অনেক কম দামে পুঁজিবাজারের কয়েকজন প্রভাবশালী ব্যক্তি ও কোম্পানি এই শেয়ার কিনেছে। এর মধ্যে বেক্সিমকো লিমিটেড কোম্পানিটির কাছ থেকে প্রায় এক কোটি শেয়ার কিনিছে। আর লুৎফর রহমানের কোম্পানি শোর ক্যাপ হোল্ডিংস লিমিডেট কিনেছে ৮০ লাখ শেয়ার। এই তথ্য কোম্পানির বিবরণপত্রে প্রকাশ করা হয়েছে। তবে এর বাইরেও তারা আরও শেয়ার কিনেছে বলে জানা গেছে।
এ ব্যাপারে ইউনিক হোটেল অ্যান্ড রিসোর্টস লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক নূর আলী বলেন, কোম্পানির বিবরণপত্রে সব ধরনের তথ্য তুলে ধরা হয়েছে। এরপরও নিয়ন্ত্রক সংস্থা যদি আরও তথ্য চায় সে তথ্য দেওয়া হবে। তিনি বলেন, বর্তমানে ওয়েস্টিন হোটেলের দৈনিক গড় ভাড়া ১৮৭ (এডিআর) ডলার। পার্শ্ববর্তী দেশগুলোর তুলনায় এটি এখনো কম। ভবিষ্যতে এডিআর ২৫০ থেকে ৩০০ ডলার পর্যন্ত উঠতে পারে। এতে কোম্পানির আয় যেমন বাড়বে। শেয়ারহোল্ডাররাও ভালো লভ্যাংশ পাবে।
কোম্পানিটির ইস্যু ব্যবস্থাপক ব্র্যাক ইপিএল লিমিটেডের ভাইস চেয়ারম্যান সাইফুল ইসলাম বলেন, কোম্পানি থেকে যে তথ্য দেওয়া হয়েছে সেটি যথাযথভাবে উপস্থাপন করে রোড শো করে বিভিন্ন প্রাতিষ্ঠানিক কোম্পানির কাছ থেকে শেয়ারপ্রতি দাম আহ্বান করা হয়েছিল। ১৫টি আর্থিক প্রতিষ্ঠান তাতে অংশ নিয়ে যে দাম দিয়েছে, সেটি গড় করে ১৮৫ টাকা নির্ধারণ করা হয়েছে। বাজারের চাহিদা থেকেই এই দর উঠে এসেছে।
তবে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ১৫টি কোম্পানির মধ্যে পাঁচটিই তাদের স্বার্থসংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠান, যারা কোম্পানির শেয়ারের দাম বেশি নির্ধারণে ভূমিকা রেখেছে। সর্বোচ্চ দাম হাঁকা লতিফ সিকিউরিটিজের ব্যবস্থাপনা পরিচালক লুৎফর রহমান বাদল বলেন, নিট সম্পদ ও কোম্পানির আয় দেখে এই দাম যথেষ্ট যুক্তিযুক্ত। তা ছাড়া নতুন হোটেল হলে কোম্পানির আয় আরও বাড়বে।
এদিকে এসইসি সূত্রে জানা গেছে, কোম্পানির পক্ষ থেকে ইতিমধ্যেই গণপ্রস্তাবের অনুমোদন চেয়ে প্রসপেক্টাস বা বিবরণপত্র জমা দেওয়া হয়েছে। এর আগে গত অক্টোবর মাসে ওয়েস্টিন হোটেলে রোড শোর আয়োজন করে কোম্পানি। শেয়ারের নির্দেশক মূল্য নির্ধারণের জন্য প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীদের এই রোড শোতে আহ্বান করা হয়। তবে অনেক কোম্পানিরই অভিযোগ, বুকবিল্ডিং পদ্ধতির নিয়ম অুনসরণ করে অনেক আগে থেকে প্রসপেক্টাস দেওয়া হয়নি বা ওয়েবসাইটে আপলোড করা হয়নি।
এ ব্যাপারে জানতে চাওয়া হলে এসইসির আইপিও বিভাগের নির্বাহী পরিচালক এ টি এম তারিকুজ্জামান প্রথম আলোকে বলেন, তাদের আবেদনপত্র পরীক্ষা করে দেখা হচ্ছে। যাচাই-বাছাইয়ে কোনো ত্রুটি ধরা পড়লে এসইসি বিধি মোতাবেক ব্যবস্থা নেবে।
প্রসঙ্গত, ইউনিক হোটেলের বর্তমান পরিশোধিত মূলধন ২৩০ কোটি টাকা, যা ১০ টাকা অভিহিত মূল্যের ২৩ কোটি শেয়ারে বিভক্ত। প্রতিষ্ঠানটি আইপিওর মাধ্যমে নতুন করে আরও তিন কোটি শেয়ার বাজারে ছাড়বে। শেয়ারবাজার থেকে সংগৃহীত টাকা কোম্পানিটির নতুন ইউনিট স্থাপনসহ ব্যবসা সম্প্রসারণ কাজে ব্যয় করা হবে।

No comments:

Post a Comment