Friday, September 24

এক দিনে শেয়ার নিষ্পত্তি ও লক-ইন বাতিলের সুপারিশ

September 24, 2010
অতিমূল্যায়িত শেয়ারবাজারকে স্থিতিশীল করতে শেয়ার সরবরাহ বাড়ানোর তাগিদ দিয়েছে অর্থ মন্ত্রণালয়সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটি।
কমিটি বলেছে, বিক্রি করা শেয়ার এক দিনের মধ্যে নিষ্পত্তি করা এবং উদ্যোক্তা ও ব্যক্তির প্লেসমেন্ট শেয়ারের ওপর আরোপ করা লক-ইন (বিক্রির ওপর বিধিনিষেধ) তুলে নেওয়ার বিষয়টি বিবেচনা করা যেতে পারে।
কমিটির চেয়ারম্যান আ হ ম মোস্তফা কামালের সভাপতিত্বে গতকাল বৃহস্পতিবার অনুষ্ঠিত এক বৈঠকে এই মতামত দেওয়া হয়।
তবে এক দিনে শেয়ার নিষ্পত্তির সিদ্ধান্ত নেওয়া হলে তা বাজারে অস্থিরতা তৈরি করবে এবং উদ্যোক্তা ও প্লেসমেন্ট শেয়ার বিক্রির ওপর নিষেধাজ্ঞা তুলে নেওয়া হলে তা সামগ্রিকভাবে বাজারের স্থিতিশীলতা ক্ষতিগ্রস্ত করবে বলেও সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা মনে করছেন।
প্রসঙ্গত, বর্তমানে এ, বি ও এন গ্রুপের শেয়ার কিনলে তিন দিন লাগে নিষ্পত্তির জন্য, তারপর সেটি বিক্রয়যোগ্য হয়। অর্থাৎ রোববার যদি কেউ শেয়ার কেনেন, তবে তিনি সেই শেয়ার বিক্রি করতে পারেন বুধবার।
সংসদীয় স্থায়ী কমিটি মনে করছে, এই সময় কমিয়ে আনা দরকার। তাদের যুক্তি হচ্ছে, এক দিনে নিষ্পত্তি হলে বাজারে শেয়ারের সরবরাহ বাড়বে। ফলে চাহিদা থাকলেও শেয়ারের আধিক্য না থাকায় যে দাম বাড়ে, তা কিছুটা সামাল দেওয়া যাবে।
বৈঠক শেষে মোস্তফা কামাল সাংবাদিকদের বলেন, বাজারে শেয়ার সরবরাহে ঘাটতি আছে। মানুষ জমি বিক্রির টাকাও শেয়ারবাজারে এনেছে। কিন্তু সে তুলনায় শেয়ার সরবরাহ নেই, যে কারণে বাজার অতিমূল্যায়িত হয়ে পড়েছে। স্থায়ী কমিটি এ কারণে শেয়ার নিষ্পত্তির সময় কমিয়ে আনা এবং উদ্যোক্তা ও ব্যক্তির প্লেসমেন্ট শেয়ার বিক্রির ওপর লক-ইন, বিশেষত ভালো কোম্পানির ক্ষেত্রে এটি বিবেচনা করতে বলেছে।
কিন্তু সূত্রগুলো বলছে, ক্রয় করা শেয়ার এক দিনে নিষ্পত্তির ব্যবস্থা নিলে কোম্পানির মোট শেয়ারে কোনো পরিবর্তন হবে না, বাড়তি গতিশীলতা তৈরি হবে মাত্র। আর এতে লাভবান হবেন স্টক ব্রোকাররা। তাঁদের কমিশন আয় ও স্টক এক্সচেঞ্জের আয় বাড়ে। অন্যদিকে এখন যে শেয়ারগুলো তিন দিনের জন্য হলেও হাতে থাকছে, বিক্রি হচ্ছে না, তাও বিক্রয়যোগ্য হওয়ায় বাজার হয়ে যাবে কেবল লেনদেনকারীদের, বিনিয়োগকারীদের নয়। এটা কৃত্রিমভাবে বা অস্বাভাবিকভাবে দাম বাড়াতে কাজে লাগবে।
অন্যদিকে লক-ইন তুলে নিলে দ্রুত দাম পেয়ে উদ্যোক্তারা তাঁদের শেয়ার বাজারে ছেড়ে দেবেন। তাতে ক্ষতিগ্রস্ত হবেন সাধারণ বিনিয়োগকারী। আর বাজারে প্লেসমেন্ট শেয়ারের রমরমা ব্যবসা হবে।
সূত্র জানায়, স্থায়ী কমিটির বৈঠকে এ দুটি প্রস্তাব আসে স্টক এক্সচেঞ্জ কর্তৃপক্ষ ও তালিকাভুক্ত কোম্পানিগুলোর অ্যাসোসিয়েশনের দিক থেকে।
এ বিষয়ে যোগাযোগ করা হলে পুঁজিবাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থা সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের (এসইসি) সাবেক চেয়ারম্যান ফারুক আহমেদ সিদ্দিকী প্রথম আলোকে বলেন, এক দিনের মধ্যে বিক্রীত শেয়ারের নিষ্পত্তি করা কারিগরি কারণেই সম্ভব নয়। আর তা করা গেলেও তাতে বাজারে শেয়ারের গতিপ্রবাহ বাড়বে ঠিকই, কিন্তু সামগ্রিকভাবে অস্থিরতা তৈরি হবে। এতে লাভবান হবে ব্রোকারেজ হাউসগুলো এবং তাদের কমিশন আয় বাড়বে। অন্যদিকে লক-ইন তুলে নিলে কারসাজি (ম্যানুপুলেশন) বাড়বে। উদ্যোক্তারা তাঁদের অর্থ তুলে নেবেন ঠিকই, কিন্তু কোম্পানি কোনোভাবেই লাভবান হবে না। সামগ্রিক স্থিতিশীলতা রক্ষা করা যাবে না।
মোস্তফা কামাল সাংবাদিকদের আরও বলেন, এসইসি কোনো বিষয়ে দ্রুত সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করে এবং বাজারে হস্তক্ষেপ করে। তাতে বাজারে এক ধরনের প্রভাব পড়ছে। তাই তাদের বলা হয়েছে, ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জ (ডিএসই), চট্টগ্রাম স্টক এক্সচেঞ্জ (সিএসই) ও তালিকাভুক্ত কোম্পানিগুলো অ্যাসোসিয়েশনের সঙ্গে পরামর্শ করে সিদ্ধান্ত নিতে পারে।
কিন্তু এসইসি নিয়ন্ত্রক সংস্থা হিসেবে স্বার্থসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের সঙ্গে পরামর্শ করে সিদ্ধান্ত নিলে তাতে স্বার্থের দ্বন্দ্ব দেখা দেয় কি না—এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ডিএসই, সিএসই উভয়েই স্বনিয়ন্ত্রক সংস্থাও বটে। আর এসইসি তাদের সঙ্গে পরামর্শ করবে এবং পরে সিদ্ধান্ত নিজের মতো করে নেবে।
কিন্তু বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বাজারসম্পর্কিত কোনো নীতিগত সিদ্ধান্তের ব্যাপারে আগেভাগেই স্বার্থসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের সঙ্গে আলোচনা করলে তাতে বিশেষ কোনো মহল সুবিধাভোগী হতে পারে। তা ছাড়া এখনো এসইসির একজন সদস্যের নেতৃত্বে একটি পরামর্শ কমিটি আছে। সেই কমিটিতে ডিএসই, সিএসই, তালিকাভুক্ত কোম্পানিগুলোর অ্যাসোসিয়েশন, মার্চেন্ট ব্যাংক অ্যাসোসিয়েশন, বাংলাদেশ ব্যাংকসহ সংশ্লিষ্ট কোম্পানিগুলোর প্রতিনিধিত্ব রয়েছে।
স্থায়ী কমিটির বৈঠকে গতকাল কমিটির সদস্য ছাড়াও তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক অর্থ উপদেষ্টা ও এসইসির সাবেক চেয়ারম্যান এ বি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম, এসইসির বর্তমান চেয়ারম্যান জিয়াউল হক খোন্দকার, তালিকাভুক্ত কোম্পানিগুলোর অ্যাসোসিয়েশন সভাপতি সালমান এফ রহমান, ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জ (ডিএসই) ও চট্টগ্রাম স্টক এক্সচেঞ্জের (সিএসই) প্রতিনিধি এবং সরকারের বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের শীর্ষ পর্যায়ের কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন।
মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম এই প্রতিবেদককে বলেন, কোন প্রেক্ষাপটে নেটিং বন্ধ করার সিদ্ধান্ত দেওয়া হয়েছিল, তা তিনি বৈঠকে বলেছেন। বিষয়টি পরীক্ষা করে তারপর পর্যায়ক্রমে চালু করার পক্ষে মত তাঁর। একই সঙ্গে তিনি বলেন, ভালো কোম্পানির উদ্যোক্তা শেয়ার লক-ইনের বাইরে রাখার প্রস্তাবটির ইতিবাচক ও নেতিবাচক সব দিক দেখেই এসইসিকে সিদ্ধান্ত নিতে হবে।
মোস্তফা কামাল সাংবাদিকদের বলেন, সরকারের ২৬টি কোম্পানির শেয়ার বাজারে ছাড়ার বিষয়ে অনেক দিনের সিদ্ধান্ত আছে, কিন্তু কাজটি হচ্ছে না। সরকারের সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন মন্ত্রণালয় যেমন—জ্বালানি ও শিল্প মন্ত্রণালয়ের এ বিষয়ে প্রয়োজনীয় বিশেষজ্ঞ জ্ঞানের অভাব আছে। তাদের বলা হয়েছে, প্রয়োজনে সরকারি বিনিয়োগ প্রতিষ্ঠান আইসিবি এমনকি এসইসিরও পরামর্শ তারা নিতে পারে। তিনি বলেন, গত বছর বেসরকারি খাতেরও মাত্র ১০-১২টি কোম্পানি বাজারে এসেছে। কেন এত কম কোম্পানি বাজারে এল, তা খতিয়ে দেখে প্রয়োজনীয় সিদ্ধান্ত নিতেও কমিটি ডিএসই, সিএসই, এসইসিকে পরামর্শ দিয়েছে।

No comments:

Post a Comment