Monday, January 31

পুঁজিবাজার নিয়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সতর্কতা ==> দেরিতে বাজার সংশোধন বেদনাদায়ক হতে পারে

Alo (January 31, 2011)

বাংলাদেশ ব্যাংক প্রয়োজন অনুযায়ী মুদ্রা সরবরাহ বা সংকুলানমূলক ব্যবস্থার কথা বললেও কার্যত মুদ্রাপ্রবাহের রাশ টেনে সংকোচননীতি নেওয়া হচ্ছে। জানুয়ারি-জুন সময়ের ষাণ্মাসিক মুদ্রানীতি অনুযায়ী, সামগ্রিকভাবে ঋণ প্রবৃদ্ধি কমিয়ে আনতে হবে বাংলাদেশ ব্যাংককে। ফলে এই ছয় মাসে দেশে ঋণের জোগান হবে অনেক কম।
কেন্দ্রীয় ব্যাংক মনে করে, চলতি বছরের বাজেটে প্রত্যাশিত মূল্যস্ফীতির হার সাড়ে ৬ শতাংশও ধরে রাখা যাবে না। জুন সময়ে তা ৭ শতাংশের আশপাশে গিয়ে ঠেকবে। এই উচ্চ মূল্যস্ফীতির কারণে ঋণের প্রবৃদ্ধিকে টেনে ধরবে বাংলাদেশ ব্যাংক।
এদিকে, বাংলাদেশ ব্যাংক মনে করে, কাঙ্ক্ষিত মূল্য সংশোধন দীর্ঘায়িত হলে অতিমূল্যায়িত শেয়ারবাজারে মূল্যধস আরও বেশি দুর্ভাগ্যজনক হবে। এ পরিস্থিতিতে কেন্দ্রীয় ব্যাংক শেয়ারবাজারে দীর্ঘ সময় ধরে বিভিন্ন ধরনের সহায়তা না দিয়ে তা বাজারের ওপর ছেড়ে দেওয়ার পরামর্শ দিয়েছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের ঘোষিত জানুয়ারি-জুন সময়ের মুদ্রানীতিতে এসব তথ্য-উপাত্ত রয়েছে। গতকাল রোববার কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গভর্নর আতিউর রহমান এক সংবাদ সম্মেলনে নতুন মুদ্রানীতি তুলে ধরেন। এ সময় ডেপুটি গভর্নর নজরুল হুদা, জিয়াউল হাসান সিদ্দিকী এবং কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ঊর্ধ্বতন পরামর্শক আল্লাহ মালিক কাজেমী উপস্থিত ছিলেন।
মুদ্রানীতির ঘোষণাপত্রে বলা হয়েছে, প্রত্যাশিত জিডিপি প্রবৃদ্ধির জন্য উৎপাদনমুখী অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে পর্যাপ্ত ঋণ জোগান দেওয়ার নীতি অনুসরণ করা হবে। অন্যদিকে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে অপচয়ী ও অনুৎপাদনশীল খাতে ঋণের প্রসার নিরুৎসাহিত করা হবে।
শেয়ারবাজারের সাম্প্রতিক মূল্যপতন সম্পর্কে মুদ্রানীতিতে বলা হয়েছে, অতিমূল্যায়িত বাজারে একপর্যায়ে ধস নামে, যা সবার জন্য বেদনাদায়ক। আর মূল্য সংশোধন অনেক দেরিতে হলে সেই ধস আরও বেদনাদায়ক হতে পারে। শেয়ারবাজারে ২০১১ সালের জানুয়ারি মাসের প্রথম দিকে যে মূল্য সংশোধন হয়েছে, তা সতর্কতার সঙ্গে স্থিতিশীল হওয়া দরকার। কেননা, মনে রাখতে হবে, সংকটের সময় সব পক্ষ থেকেই সংকট উত্তরণে সম্ভাব্য সব সহায়তা দেওয়া হয়েছে। কিন্তু সংকট-পরবর্তী সময়ে বাজারকে তার নিজস্ব গতিতে টেকসই পথে এগোতে দেওয়া উচিত হবে।
কেন্দ্রীয় ব্যাংক আরও বলেছে, বাজারে সংশ্লিষ্ট অসাধু ব্যক্তিরা যাতে শেয়ারের দর অত্যধিক বাড়াতে কিংবা কমাতে না পারেন, এর জন্য নিয়ন্ত্রক কর্তৃপক্ষের পর্যাপ্ত নিরাপত্তা কৌশল হাতে নেওয়া উচিত হবে।
মুদ্রানীতিতে দেশের বর্তমান জমির বাজারদরও (রিয়েল এস্টেট) অতিমূল্যায়িত বলে উল্লেখ করে এই বাজারেও পতনোন্মুখ অবস্থা আটকাতে জরুরি ও প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে সরকারকে তাগিদ দেওয়া হয়েছে।
মুদ্রানীতি ঘোষণা করে গভর্নর বলেন, চলতি অর্থবছরের দ্বিতীয়ার্ধে মুদ্রানীতি প্রথমার্ধের মতোই উৎপাদনমুখী অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের সহায়ক থাকবে। তবে অভ্যন্তরীণ ঋণের মাত্রাতিরিক্ত প্রবৃদ্ধি দ্বারা মূল্যস্ফীতির চাপ সৃষ্টি রোধ করার জন্য অপচয়ী অনুৎপাদনশীল খাতে ব্যাংকঋণের প্রসার নিরুৎসাহিত করা হবে। বাস্তবতার নিরিখে প্রকৃত পরিস্থিতির আলোকে মুদ্রানীতি বাস্তবায়ন করা হবে।
আতিউর রহমান বলেন, অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে জোরালো চাঙা ভাব ফিরে আসায় ও প্রবাসী-আয়ে প্রবৃদ্ধি কমে আসায় টাকা ও বৈদেশিক মুদ্রাবাজারে বিগত সময়ের তারল্য-উদ্বৃত্ত চলতি অর্থবছরে আর নেই। বরং বাংলাদেশ ব্যাংককে বাজারে টাকা ও মার্কিন ডলার জোগান দিতে হচ্ছে। রপ্তানির বড় প্রবৃদ্ধি সত্ত্বেও আমদানিতে তার চেয়ে বেশি প্রবৃদ্ধি থাকায় ডলারের তুলনায় টাকার মূল্যমান কমে যাচ্ছে। বৈদেশিক লেনদেনে এই চাপ চলতি অর্থবছরে নিট বৈদেশিক সম্পদ বৃদ্ধির হার বেশ কম হবে।
মূল্যস্ফীতি প্রসঙ্গে গভর্নর বলেন, চলতি অর্থবছরের দ্বিতীয়ার্ধে জ্বালানি শক্তির দাম পুনর্নির্ধারিত হতে পারে। এতে খাদ্যবহির্ভূত পণ্যে আরেক দফা মূল্যস্ফীতি যোগ হতে পারে।
বিশ্বের বিভিন্ন দেশ ও অঞ্চলে বৈরী আবহাওয়ার কারণে খাদ্যমূল্য বেড়েছে। জ্বালানি ও খাদ্যবহির্ভূত পণ্যের মূল্যও বাড়ার দিকে। এই প্রেক্ষাপটে ১২ মাসের গড় ভিত্তিতে মূল্যস্ফীতি অর্থবছরের দ্বিতীয়ার্ধে এসে খুব দ্রুত হারে কমবে মনে হয় না। ফলে চলতি অর্থবছরের বাজেটে প্রত্যাশিত গড় মূল্যস্ফীতির হার সাড়ে ৬ শতাংশ মাত্রায় নেমে আসার সম্ভাবনা কম। বরং এই হার জুন শেষে ৭ শতাংশের আশপাশে উঠে যেতে পারে বলে মনে করে কেন্দ্রীয় ব্যাংক।
ঋণ প্রবৃদ্ধি কমবে: গত অর্থবছরে অভ্যন্তরীণ ঋণে প্রবৃদ্ধি ছিল ১৭ দশমিক ৬ শতাংশ। ২০১১ সালের শেষার্ধে অর্থাৎ জুন শেষে ঋণের প্রবৃদ্ধি ধরা হয়েছে ১৭ দশমিক ৯ শতাংশ। কিন্তু ইতিমধ্যে নভেম্বর পর্যন্ত হিসাবে প্রবৃদ্ধি হয়েছে ২৪ দশমিক ২ শতাংশ। ফলে আগামী ছয় মাসে এই ঋণ অনেক কমে আসবে বলে ধরে নেওয়া যায়।
অন্যদিকে বেসরকারি খাতে ঋণের প্রবৃদ্ধি নভেম্বর পর্যন্ত হয়েছে ২৭ দশমিক ৮ শতাংশ। আগামী জুন শেষে তা ১৬ শতাংশে নামিয়ে আনার লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে। ঋণের প্রবৃদ্ধি এই পর্যায়ে নামাতে মুদ্রা সরবরাহ ১৫ দশমিক ২ শতাংশে নামিয়ে আনা হবে। গত নভেম্বরে যা ছিল ১৯ দশমিক ৪ শতাংশ।
বেসরকারি খাতে ঋণ প্রবৃদ্ধি কমানোর বিষয়ে প্রশ্ন করা হলে ডেপুটি গভর্নর নজরুল হুদা বলেন, যেসব ব্যাংকের ঋণ আমানতের বেশি রয়েছে, তাদের প্রত্যেকের সঙ্গে পৃথক বৈঠক করেছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। ব্যাংকগুলোকে ঋণ-আমানত অনুপাত অনুসরণের পরামর্শ দেওয়া হয়েছে। তিনি বলেন, ‘আমরা উৎপাদন খাতে ঋণ দেওয়ার কথা বলেছি, অনুৎপাদন খাতে নয়।’
ঋণের সুদে ১৩ শতাংশের সীমা আরোপ করা আছে—এটি পরিবর্তন করা হবে কি না প্রশ্নের জবাবে নজরুল হুদা বলেন, ‘আমরা ১৯৯০ সাল থেকে সুদ নির্ধারণের দায়িত্ব ব্যাংকগুলোর ওপর ছেড়ে দিয়েছিলাম। কিন্তু বিশেষ পরিস্থিতি বিবেচনায় কিছু ক্ষেত্রে তা আবার আরোপ করা হয়েছিল। বর্তমান পরিস্থিতিতে আবার তা বিবেচনা করা হবে কি না সেটি একটি গুরুত্বপূর্ণ নীতি সিদ্ধান্ত। এটা করতে হলে সব দিক বিবেচনায় নিয়ে করতে হবে।

No comments:

Post a Comment