Sunday, March 20

 শেয়ার পুনঃক্রয় নিয়ে তাড়াহুড়ো না করার পরামর্শ

Alo (March 19, 2011)

ঘটনাটি ১৯৮৭ সালের অক্টোবর মাসের। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্ক স্টক এক্সচেঞ্জে ব্যাপক দরপতন শুরু হয়। একপর্যায়ে আরও পতনের আশঙ্কায় সিটিগ্রুপ, আইবিএমসহ অনেক বড় বড় কোম্পানি তখন বাজারমূল্যের চেয়ে বেশি দাম দিয়ে নিজেদের কোম্পানির শেয়ার পুনঃক্রয় (বাইব্যাক) করার ঘোষণা দেয়।
ঘোষণার পরের দিন দরপতন শুধু ঠেকেইনি, আবারও বাড়তে থাকে ওই সব কোম্পানির শেয়ারের দাম। এভাবে পতনোন্মুখ পরিস্থিতিতে শেয়ারের দাম ধরে রেখে তা বাড়াতে ভূমিকা রেখেছিল শেয়ার পুনঃক্রয় পদ্ধতি।
গত ডিসেম্বর থেকে বাংলাদেশের শেয়ারবাজারে বড় ধরনের ধস শুরু হয়, যা জানুয়ারি মাসে গড়ায়। এতে ক্ষুব্ধ বিনিয়োগকারীদের বিক্ষোভ, মিছিল, ভাঙচুর, রাস্তা অবরোধসহ সার্বিক অবস্থা এমন পর্যায়ে উপনীত হয় যে ঘোষণা দিয়ে বাজারের স্বাভাবিক লেনদেন বন্ধ রাখতে হয় কয়েক দিন।
ওই সময় (২৩ জানুয়ারি) রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন ‘পদ্মা’য় বাজারসংশ্লিষ্ট সব পক্ষের সঙ্গে দিনভর বৈঠক করেন অর্থমন্ত্রী। ওই দিনই বিকেলে সচিবালয়ে সংবাদ সম্মেলন করে অর্থমন্ত্রী জানান, ২৫ জানুয়ারি থেকে লেনদেন শুরু হবে এবং বাজার চলবে বাজারের গতিতে। অর্থমন্ত্রী শেয়ার পুনঃক্রয় পদ্ধতি চালুর কথা ওই সময়ই প্রথম উল্লেখ করেন।
এরপর অবশ্য বিশেষজ্ঞদের দিক থেকে প্রশ্ন ওঠে, বাজারের খারাপ সময়ে অর্থমন্ত্রী কি শেয়ারের দাম বাড়ানোর জন্যই পুনঃক্রয় পদ্ধতি চালুর ঘোষণা দিলেন? আমেরিকার মতো অত্যন্ত পরিপক্ব বাজারের সঙ্গে বাংলাদেশের অপরিণত শেয়ারবাজারকে মেলানোই বা কতটুকু যুক্তিসংগত?
প্রসঙ্গত, শেয়ার পুনঃক্রয় পদ্ধতি হচ্ছে কোম্পানি কর্তৃক বাজার থেকে নিজের কোম্পানির শেয়ার কিনে নিয়ে কোম্পানির মোট শেয়ারের সংখ্যা কমিয়ে আনা।
প্রায় সব দেশের কোম্পানি আইনেই শেয়ার পুনঃক্রয় পদ্ধতিটি চালু থাকলেও বাংলাদেশের আইনে এখনো তা অনুপস্থিত। প্রায় শত বছর আগের ১৯১৩ সালের কোম্পানি আইন যখন ১৯৯২ সালে সংশোধিত হয়, তখনো বিষয়টি কোম্পানি আইনের বাইরেই থেকে যায়। অবশ্য ১৯৯৬ সালের শেয়ার কেলেঙ্কারির পর শেয়ার পুনঃক্রয়ের বিষয়টি আলোচনায় এসেছিল, তবে তা স্থায়ী হয়নি।
জানা গেছে, এরই মধ্যে শেয়ার পুনঃক্রয় আইনের একটি খসড়া প্রস্তুত করেছে নিয়ন্ত্রক সংস্থা সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (এসইসি)। গত মঙ্গলবার ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জ (ডিএসই), চট্টগ্রাম স্টক এক্সচেঞ্জ (সিএসই) এবং পাবলিকলি লিস্টেট কোম্পানিজ অ্যাসোসিয়েশনের সঙ্গে খসড়ার ওপর একটি পর্যালোচনা বৈঠকের আয়োজন করে এসইসি।
জানা গেছে, খসড়াটি প্রস্তুত করা হয়েছে সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ বোর্ড অব ইন্ডিয়ার (এসইবিআই) ১৯৯৯ সালের বাইব্যাক রেগুলেশনসের আদলে। এসইসি শিগগির তা অর্থ মন্ত্রণালয়ে পাঠাবে। আর অর্থ মন্ত্রণালয় তা যাচাই-বাছাই করে পাঠিয়ে দেবে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ে। বাণিজ্য মন্ত্রণালয় কয়েক মাস ধরেই কোম্পানি আইনের অসংখ্য ধারা সংশোধনের কাজ করছে।
বাণিজ্যসচিব মো. গোলাম হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, কোম্পানি আইন সংশোধনের বিষয়টি অনেক সময়সাপেক্ষ। এখনো আলাপ-আলোচনার পর্বই শেষ হয়নি। পুঙ্খানুপুঙ্খ বিশ্লেষণ করেই আইনে নতুন বিধান সংযোজন করা হবে।
এসইসির চেয়ারম্যান জিয়াউল হক খোন্দকার প্রথম আলোকে বলেন, শেয়ার পুনঃক্রয়ব্যবস্থা চালু বিষয়ে আইন করা হচ্ছে বিনিয়োগকারীদেরই স্বার্থে। কয়েক দিনের মধ্যে এ বিষয়ে একটি খসড়া অর্থ মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হবে।
খসড়া আইন: এসইসির প্রস্তুতকৃত খসড়ায় বলা হয়েছে, কোনো কোম্পানি শেয়ার পুনঃক্রয় করার পরবর্তী দুই বছরের মধ্যে তার মূলধন বাড়াতে পারবে না। দুই বছরের মধ্যে বোনাস শেয়ার ছাড়া অন্য কোনো ধরনের লভ্যাংশও দেওয়া যাবে না। অতিরিক্ত মূলধন অথবা সিকিউরিটিজ প্রিমিয়াম হিসেবে ব্যবহার করে শেয়ার পুনঃক্রয় করা যাবে। কোম্পানির পর্ষদে পাস হওয়ার এক বছরের মধ্যে পুনঃক্রয় সম্পন্ন করতে হবে।
খসড়ায় আরও বলা হয়েছে, পুনঃক্রয় আইন লঙ্ঘনের দায়ে সংশ্লিষ্ট কোম্পানির দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তাকে আর্থিক দণ্ড গুনতে হবে। তবে কোম্পানিকে জরিমানা দিতে হবে সর্বনিম্ন এক লাখ টাকা, কিন্তু সর্বোচ্চের কোনো সীমা নেই।
এ ছাড়া খসড়ায় বুক বিল্ডিং পদ্ধতি ও দরপত্র আহ্বান—দুভাবে শেয়ার পুনঃক্রয়ের কথা বলা হয়েছে। আরও বলা হয়েছে, কোম্পানির পরিশোধিত মূলধনের ২৫ শতাংশের বেশি শেয়ার পুনঃক্রয় করা যাবে না। পুনঃক্রয়ের আগে যৌথ মূলধনী কোম্পানি ও ফার্মসসমূহের পরিদপ্তর (আরজেএসসি) ও এসইসি থেকে আর্থিক সংগতির সত্যায়ন নিতে হবে। তবে শেয়ার পুনঃক্রয়ের কারণ ও সময়সীমা স্পষ্টভাবে আগেই জানাতে হবে আরজেএসসি ও এসইসিকে।
সাধারণত তারল্য ব্যবহারের সুযোগ না থাকা, কোম্পানির অবলুপ্তি, বিশেষ পরিস্থিতিতে শেয়ারের মূল্য বাড়ানো, কর কম দেওয়া ইত্যাদি কারণে শেয়ার পুনঃক্রয় করা হয়। কোম্পানি যদি দেখে যে অতিরিক্ত তারল্য বিনিয়োগের কোনো প্রকল্প নেই, তখন ওই কোম্পানির কর্তৃপক্ষ বাজার থেকে নিজেদের শেয়ার কিনে নেয়। কোনো কোম্পানি যদি মনে করে, বাজারে তার শেয়ার অবমূল্যায়িত, তখনো শেয়ার পুনঃক্রয়ের উদ্যোগ নেওয়া হয়।
২০০০ সালে ভারতের বাজারে তালিকাভুক্ত বাজাজ অটো লিমিটেড তারল্য ব্যবহারের সুযোগ না থাকায় বিপুল পরিমাণ শেয়ার কিনে নিয়েছিল। সম্প্রতি ভারতীয় রিলায়েন্স কোম্পানিও এভাবে শেয়ার কিনে নেয়। নগদ লভ্যাংশের ওপর কর বেশি দিতে হলেও অনেক কোম্পানি বিনিয়োগকারীদের মুনাফা পাইয়ে দিতে পুনঃক্রয়ের পথ বেছে নেয়। আবার কেউ কেউ কোম্পানি অবলুপ্তির জন্য আদালতের নির্দেশকে এড়াতে চান। তারাও বেছে নেয় শেয়ার পুনঃক্রয়ের পথ।
বিশেষজ্ঞদের মত: বাংলাদেশের ক্ষেত্রে কোনটি বিবেচনায় নেওয়া হচ্ছে—এ প্রসঙ্গে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা ও এসইসির সাবেক চেয়ারম্যান এবি মির্জ্জা মো. আজিজুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, ‘পুনঃক্রয়ের বিধান থাকতে পারে। তবে ব্যবস্থাটি চালুর জন্য এত তাড়াহুড়ো করার কিছু নেই। যতটুকু জেনেছি, ভারতীয় শেয়ার পুনঃক্রয়ব্যবস্থার আদলে আমাদেরটি চালুর উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। এটি ঠিক নয়। ভারতের বাজার অনেক পরিপক্ব। কোম্পানির সংখ্যা, কোম্পানি সুশাসন, মার্চেন্ট ব্যাংকগুলোর আচরণ ইত্যাদির সঙ্গে আমাদের বাজার মিলবে না।’
মির্জ্জা আজিজ আরও বলেন, ‘মনে হচ্ছে পুনঃক্রয়ের মাধ্যমে শেয়ারের মূল্য বাড়ানোই এদের উদ্দেশ্য। তাহলে কিন্তু হিতে বিপরীত হবে। তাই যথেষ্ট সময় নিয়ে চিন্তা করা উচিত।’
বুক বিল্ডিং পদ্ধতির মতো শেয়ার পুনঃক্রয় পদ্ধতিরও অপব্যবহার হয় কি না প্রশ্নের জবাবে মির্জ্জা আজিজ বলেন, কৃত্রিমভাবে শেয়ারের দাম কমিয়ে কেউ যাতে পুনঃক্রয়ের সুযোগ নিতে না পারে, তার প্রতিরোধ ব্যবস্থা থাকতে হবে। তিনি আরও বলেন, বাংলাদেশের বাজারটা বুঝতে হবে। আর তাই আমি মনে করি, পুনঃক্রয়ব্যবস্থা চালুর সময় এখন নয়।
ডিএসইর সাবেক প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফিন্যান্স বিভাগের অধ্যাপক সালাহউদ্দিন আহমেদ খান প্রথম আলোকে বলেন, ‘আইনে শেয়ার পুনঃক্রয়ব্যবস্থা থাকা দরকার। কিন্তু সরকারকে আগে এই ব্যবস্থা চালুর উদ্দেশ্যটা পরিষ্কার করতে হবে।’
সালাহউদ্দিন আহমেদ খানের মতে, বাজার স্থিতিশীল হয়ে উঠছে। তাই বাজারের জন্য সম্পূর্ণই নতুন—এমন কোনো বিষয় চালুর ক্ষেত্রে অনেক বেশি সতর্কতা দরকার। আর অতিরিক্ত তারল্য রয়েছে, এমন কোম্পানিকেই শেয়ার পুনঃক্রয়ের সুযোগ দেওয়া যেতে পারে বলে তিনি মনে করেন। নিম্ন মৌল ভিত্তির কোম্পানিকে শেয়ার পুনঃক্রয়ব্যবস্থার বাইরে রাখার পরামর্শ দেন তিনি।
মার্চেন্ট ব্যাংক অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি শেখ মর্তুজা আহমেদ প্রথম আলোকে বলেন, শেয়ার পুনঃক্রয়ব্যবস্থায় শেয়ারের সংখ্যা কমে যায়, মূল্য অনুপাতে আয় বেড়ে যায় এবং প্রকৃতপক্ষে বিনিয়োগকারীরা লাভবান হয়ে থাকেন। তাই বিষয়টি তিনি চালুর পক্ষে।
তবে পদ্ধতিটির অপব্যবহার হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে বলেও মনে করেন শেখ মর্তুজা আহমেদ। তিনি বলেন, দেখা গেছে, কোনো কোম্পানি কারণে-অকারণে নিজের শেয়ার কিনবে, আর লভ্যাংশ কম দেবে। বাজারের সব পক্ষের সঙ্গে বৈঠক করে তাই শেয়ার পুনঃক্রয়ব্যবস্থার ত্রুটি-বিচ্যুতিগুলো আগে বের করা দরকার বলে তিনি মনে করেন।
শেখ মর্তুজা আহমেদ সতর্ক করে দিয়ে বলেন, বুক বিল্ডিং পদ্ধতিটিও বিশ্ব স্বীকৃত পদ্ধতি। অথচ এই পদ্ধতির অপব্যবহারের নজির তৈরি হয়েছে দেশে। যে কারণে তা সংশোধনেরও উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। একইভাবে শেয়ার পুনঃক্রয়ব্যবস্থাও প্রায় সব দেশেই রয়েছে। আমাদের এত দিন ছিল না, এখন হচ্ছে। কিন্তু এর অপব্যবহারের দিকটি আগেই খেয়াল করতে হবে। বুক বিল্ডিংয়ের অপব্যবহারের চেয়ে শেয়ার পুনঃক্রয়ব্যবস্থার অপব্যবহারে বাজার বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে বলে তিনি মনে করেন।

No comments:

Post a Comment