Thursday, March 24

 ভেতর-বাইরের চাপে ভালো নেই অর্থনীতি

Alo (March 24, 2011)

ভালো নেই দেশের অর্থনীতি। নানামুখী সংকটের মধ্যে সামষ্টিক অর্থনীতির সূচকগুলো। ভেতর-বাইরে দুই দিক থেকেই চাপ বাড়ছে। এতে একদিকে বিনিয়োগ যেমন ব্যয়বহুল হচ্ছে, অন্যদিকে প্রতিদিনের জীবনযাত্রার ব্যয় নিয়ে উৎকণ্ঠায় আছে সীমিত আয়ের সাধারণ মানুষ।
সরকার বড় বড় প্রকল্প তৈরি করছে, সেখানে হাজার হাজার কোটি টাকা ব্যয়ের পরিকল্পনাও রয়েছে। অথচ বড় বড় এসব পরিকল্পনা ও মনোযোগের আড়ালে সামষ্টিক অর্থনীতির স্থিতিশীলতা নিয়েই দেখা দিয়েছে বড় দুশ্চিন্তা।
দীর্ঘ বিনিয়োগ-বন্ধ্যার পর পরিস্থিতি খানিকটা স্বাভাবিক হতে শুরু করলেও উদ্যোক্তাদের স্বস্তি কেড়ে নিয়েছে ডলারের উচ্চমূল্য; তাও ব্যাংক দিতে পারছে না। সুদের হার বাড়ছেই। কয়েকটি ব্যাংকের অদক্ষতার কারণে দেখা দিয়েছে নগদ অর্থের সংকট। এসব ব্যাংক সীমার তুলনায় ঋণ বেশি দিয়ে বিপাকে আছে। বাংলাদেশ ব্যাংকও এখন অর্থ সরবরাহের গতির রাশ টানতে চাইছে।
মূল্যস্ফীতির চাপ তো আগে থেকেই ছিল। নতুন করে দেখা দিয়েছে বাইরের চাপ। রপ্তানি বাড়লেও আমদানি-ব্যয় বেড়েছে তার চেয়েও বেশি। কমছে প্রবাসী-আয়, ফিরে আসছেন প্রবাসী শ্রমিকেরা। শেয়ারবাজার কোন দিকে যাচ্ছে, সেটি নিয়েও রয়েছে চরম অনিশ্চয়তা। সাধারণ মানুষের আমানতের টাকায় তৈরি করা হয়েছে পাঁচ হাজার কোটি টাকার ‘বাংলাদেশ ফান্ড’। আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) মনে করছে, এই তহবিল নতুন করে বিপদ ডেকে আনবে।
জ্বালানিসংকট এখনো রয়ে গেছে। বৈদেশিক সাহায্য কমেছে। কমে গেছে বিদেশি বিনিয়োগ। বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচির (এডিপি) বাস্তবায়ন দেখাতে কেবল স্থানীয় মুদ্রানির্ভর প্রকল্পের ব্যয় বাড়ানো হচ্ছে। যে অর্থ ব্যয়ে জবাবদিহি কম, দুর্নীতির সুযোগ থাকে, সেই অর্থ ব্যয়ই বেশি হচ্ছে।
রপ্তানি-আয় বৃদ্ধি ও রাজস্ব আদায় বাড়ানো ছাড়া অর্থনীতিতে এখন ভালো সংবাদ খুব একটা নেই। আয় বাড়লেও সে তুলনায় ব্যয় বাড়ছে বেশি। খাদ্য ও জ্বালানি খাতে ভর্তুকি বেড়ে যাওয়ায় টান পড়ছে বাজেট ব্যবস্থাপনায়।
বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ ও ট্যারিফ কমিশনের সাবেক চেয়ারম্যান এম এ তসলিম অর্থনীতির অভ্যন্তরীণ ও বহিস্থ খাত বিশ্লেষণ করে এ মুহূর্তে দেশের সামষ্টিক অর্থনীতি একটা বড় চাপের মধ্যে রয়েছে বলে মত দেন। তিনি বলেন, দেশের বৈদেশিক লেনদেন একটা চাপের মধ্যে পড়েছে। আমদানি পণ্যের দাম বাড়ছে। কিন্তু দেশের বৈদেশিক মুদ্রা আয়ের একক বড় খাত প্রবাসী-আয়ে (রেমিট্যান্স) প্রবৃদ্ধি নেই। অথচ এই প্রবাসী-আয় দিয়ে আমদানি-ব্যয়ের বড় অংশ পরিশোধ হতো। এ পরিস্থিতিতে স্বভাবতই টাকার মূল্যমান কমে আসবে, যার প্রভাব পড়বে আবার দেশের মূল্যস্তরে। কিন্তু তাতে মুদ্রানীতিকে সংকুচিত করে সামাল দেওয়া যাবে বলে মনে হয় না।
অধ্যাপক তসলিম বলেন, জনশক্তি রপ্তানি কমছে। ফিরে আসছেও বিপুল পরিমাণে। কেবল যে মন্দা ও মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশে সংঘাতের কারণেই বিদেশে কর্মসংস্থান কমছে, এটা বোধ হয় ঠিক নয়। সৌদি আরব ও মালয়েশিয়ায় বিপুল পরিমাণ জনশক্তি রপ্তানি কমেছে। কী কারণে কমছে, তা ভালোভাবে খতিয়ে দেখতে পরামর্শ দেন তিনি।
কোথায় গেল টাকা: এক বছর আগেও দেশের ব্যাংকগুলো নগদ অর্থ হাতে নিয়ে বসে ছিল। আর এখন বেশ কিছু ব্যাংক নগদ অর্থসংকটে ভুগছে। বেশির ভাগ ব্যাংকই সীমার অতিরিক্ত ঋণ দিয়েছে। কোনো কোনো ব্যাংক ঋণ দিয়েছে আমানতের তুলনায় বেশি। এসব ব্যাংক এখন আন্তব্যাংক লেনদেনের (কলমানি) বাজার থেকে চড়া সুদে ঋণ নিয়ে দৈনন্দিন ব্যয় মেটাচ্ছে। ফলে অদক্ষ ব্যবস্থাপনার খেসারত দিতে হচ্ছে অর্থনীতিকে। আর এ কারণে এখন ব্যাংকে টাকা নেই বলে শুরু হয়েছে হাহাকার।
এক বছর আগেও আমানতের সুদহার নেমে গিয়েছিল ১০ শতাংশের নিচে। আর এখন তা ১২ থেকে ১৩ শতাংশে উঠে গেছে। এর সঙ্গে সামঞ্জস্য রাখতে বাংলাদেশ ব্যাংক ঋণের সুদহারের ওপর আরোপিত ১৩ শতাংশ সীমা তুলে নিয়েছে। এর মাধ্যমে ব্যাংকঋণ হয়ে পড়েছে আরও ব্যয়বহুল।
আইএমএফের একটি প্রতিনিধিদল সম্প্রতি বাংলাদেশ সফর শেষে অর্থনৈতিক পরিস্থিতি পর্যালোচনা করে ১৭ মার্চ একটি প্রতিবেদন দিয়েছে। সেখানে আইএমএফ বলেছে, মুদ্রা খাতের কারণে বাংলাদেশের আর্থিক ব্যবস্থা এবং বৃহত্তর অর্থনীতিতে বড় ধরনের চাপ তৈরি হয়েছে। অতি দ্রুত ঋণের প্রবৃদ্ধি ঘটেছে। ২৮ শতাংশ ঋণ প্রবৃদ্ধি বাংলাদেশের জন্য সর্বকালের রেকর্ড। আইএমএফ মনে করে, এই প্রবৃদ্ধি অনিয়ন্ত্রিত এবং এতে আমদানির চাহিদাও বেড়ে গেছে। এমনকি জমির মূল্যও বাড়িয়ে দিয়েছে। এ অবস্থায় মূল্যস্ফীতির চাপ কমাতে ঋণ নিয়ন্ত্রণ জরুরি।
ডলারের হাহাকার: সারা বিশ্বে ডলার ভালো নেই, ভালো আছে কেবল বাংলাদেশে। সর্বত্রই ডলারের দর কমছে, কেবল বাড়ছে বাংলাদেশে। কয়েক মাস ধরেই দেশে ডলারের হাহাকার চলছে। আগে যেখানে প্রতিদিন দুই থেকে আড়াই কোটি ডলারের লেনদেন হতো, এখন তা ৫০ লাখ ডলারে নেমে এসেছে। মূলত চাহিদার তুলনায় জোগান কম হওয়ায় বেড়েছে ডলারের দর। অনেক ব্যাংক আমদানির জন্য ঋণপত্র বা এলসি খুলতে ব্যর্থ হয়েছে। কিছু ব্যাংক ৭৩ টাকায় ডলার বিক্রি করেছে। এর ফলে বাড়ছে আমদানি-ব্যয়।
জানা গেছে, গত বছরের জুলাই মাসের তুলনায় ডিসেম্বর মাসের শেষে এসে ডলারের বিপরীতে টাকার মূল্যমান ১ দশমিক ৯৩ শতাংশ কমে গিয়েছিল। আর ডিসেম্বর মাসের তুলনায় জানুয়ারি মাসের শেষে এসে ডলারের বিপরীতে টাকার দরপতন হয়েছে প্রায় আড়াই শতাংশ। পরের মাসে পরিস্থিতি আরও খারাপ হয়েছে।
আইএমএফ বলছে, ডলারের ঘোষিত দর ও বাজারদরের মধ্যে পার্থক্য হয়েছে সাড়ে ৩ শতাংশ, যা আইএমএফের সঙ্গে করা সমঝোতার বরখেলাপ। এ কারণে বাংলাদেশ ব্যাংককে বারবার ডলার ছেড়ে বাজারে হস্তক্ষেপ করতে হচ্ছে। ডলারের বিনিময় হার বাড়লে লাভবান হয় প্রবাসী-আয়কারী ও রপ্তানিকারকেরা। তবে আমদানিনির্ভরতা বেশি থাকায় শেষ পর্যন্ত দেশ সার্বিকভাবে লাভবান হয় না। ডলারের বর্তমান সংকটে বিপাকে পড়েছেন ব্যবসায়ীরা, পণ্য আমদানিতে বেশি দর দিতে হচ্ছে।
যোগাযোগ করা হলে ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন এফবিসিসিআইয়ের সাবেক সভাপতি মীর নাসির হোসেন বলেন, ‘একটা সংকটকালের মধ্যেই যেন আমরা যাচ্ছি। বিশ্বব্যাপী বহুমাত্রিক কারণে একটা অস্থিরতা, অর্থনৈতিক মন্দা অবস্থা দেখা দিয়েছে। এতে আমাদের বৈদেশিক খাত অর্থাৎ প্রবাসী-আয় কমছে, আন্তর্জাতিক বাজারে পণ্যমূল্য বাড়ার কারণে ব্যয়বহুল হয়ে পড়ছে আমদানি।’ তাঁর মতে, এ দুইয়ের প্রভাবে দেশের বিনিয়োগ ও বাণিজ্যে প্রতিক্রিয়া হচ্ছে। আবার দেশে জ্বালানি শক্তির অভাবে উৎপাদন-বিনিয়োগ আটকে থাকছে।
বাড়ছে বাইরের চাপ: দীর্ঘদিন বন্ধ থাকার পর শ্রমিক যেতে শুরু করেছিল লিবিয়ায়। সেখানে কর্মরত ছিলেন প্রায় ৬০ হাজার শ্রমিক। তাঁদের মধ্যে ৩০ হাজার ফিরে এসেছেন, বাকিদেরও হয়তো আসতে হবে। এমনিতেই বিভিন্ন দেশে বাংলাদেশি শ্রমিক যাওয়ার পরিমাণ কমে আসছিল, লিবিয়াসংকট পরিস্থিতি আরও খারাপ করে দিয়েছে।
কয়েক বছর ধরে প্রবাসী-আয়ের ওপর ভর করে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ বাড়ছিল। প্রতিবছরই রেকর্ড পরিমাণ বৃদ্ধি ছিল প্রবাসী-আয়ে। সেই প্রবৃদ্ধি থমকে গেছে। চলতি অর্থবছরের প্রথম সাত মাস অর্থাৎ জুলাই থেকে ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত সময়ে প্রবাসী-আয়ে প্রবৃদ্ধি হয়েছে মাত্র ২ দশমিক ৪৯ শতাংশ, অথচ আগের অর্থবছরের একই সময়ে তা ছিল প্রায় ১৯ শতাংশ।
বৈদেশিক মুদ্রা আয়ের আরেক উৎস রপ্তানি আয়ে প্রায় ৪০ শতাংশ প্রবৃদ্ধি ঘটলেও আমদানি-ব্যয়ে প্রবৃদ্ধি প্রায় ৪১ শতাংশ। বাণিজ্য ঘাটতি বেড়ে হয়েছে ৬০০ কোটি ডলারের বেশি। মূলত, সুতা, জ্বালানি তেল ও খাদ্যপণ্যের দাম বাড়ায় বৃদ্ধি পাচ্ছে আমদানি-ব্যয়।
আইএমএফ মনে করছে, সামগ্রিকভাবে বাংলাদেশে লেনদেনের ভারসাম্যের ওপর চাপ প্রকট হচ্ছে। বিশেষ করে আমদানি-ব্যয় বৃদ্ধি ও প্রবাসী-আয় কমে যাওয়ায় চলতি হিসাবের লেনদেন দীর্ঘদিন পরে ভারসাম্যহীন হয়ে পড়ছে।
সংকট তৈরি হয়েছে বৈদেশিক সাহায্যের ক্ষেত্রেও। সাহায্যের পরিমাণ বিপজ্জনক পর্যায়ে নেমে গেছে। চলতি অর্থবছরের প্রথম আট মাসে (জুলাই-ফেব্রুয়ারি) ঋণ ও অনুদান মিলিয়ে বাংলাদেশ প্রকৃত সাহায্য পেয়েছে মাত্র ৩৭ কোটি ৩৬ লাখ ডলার। আর গত অর্থবছরের একই সময়ে তা ছিল ১৪৩ কোটি ডলার। মূলত ব্যবহার করতে না পারায় সাহায্য মিলছে না। ফলে উচ্চাভিলাষী বিশাল এডিপির আয়তন কমানো হয়েছে। বাংলাদেশের বৃহত্তম দাতা দেশ জাপানের প্রাকৃতিক বিপর্যয় বৈদেশিক সাহায্য নিয়ে দুশ্চিন্তা আরও বাড়িয়ে দিয়েছে।
মূল্যস্ফীতির চাপ তো আছেই: স্বস্তিতে নেই সীমিত আয়ের সাধারণ মানুষও। মূল্যস্ফীতির হার বেড়েই চলছে। এখন পর্যন্ত অর্থবছরের জানুয়ারি পর্যন্ত অর্থাৎ সাত মাসের মূল্যস্ফীতির হিসাব পাওয়া যাচ্ছে। গত জানুয়ারি মাসে পয়েন্ট-টু-পয়েন্ট ভিত্তিতে মূল্যস্ফীতির হার দাঁড়ায় ৯ দশমিক ০৪ শতাংশে। আর বার্ষিক গড় ভিত্তিতে এই হার ৮ দশমিক ১৪ শতাংশ। জানুয়ারি মাসে খাদ্যের মূল্যস্ফীতির হার হয়েছে ১১ দশমিক ৯১ শতাংশ, যা বিগত ৩০ মাসের মধ্যে সর্বোচ্চ। আর পল্লি এলাকায় খাদ্যের মূল্যস্ফীতির হার প্রায় সাড়ে ১২ শতাংশ।
মূল্যস্ফীতির এই চাপের কারণে সীমিত আয়ের সাধারণ মানুষের এখন খাদ্যের জন্য আগের চেয়ে অনেক বেশি অর্থ ব্যয় করতে হচ্ছে। গ্রামের মানুষ খরচ করছে আরও বেশি। কেন্দ্রীয় ব্যাংক মুদ্রার জোগানে লাগাম টেনে আর সরকার খোলাবাজারে সাশ্রয়ী মূল্যে চাল বিক্রিসহ বিভিন্ন কার্যক্রম হাতে নিয়েও মূল্যস্ফীতির ঊর্ধ্বমুখী-প্রবণতা রুখতে পারছে না। বিশ্ববাজারে দাম বেড়ে যাওয়ার পাশাপাশি অভ্যন্তরীণভাবে বাজার ব্যবস্থাপনার দুর্বলতা বিশেষত সরবরাহজনিত কিছু সংকট মূল্যস্ফীতিকে ক্রমেই উসকে দিচ্ছে।
এ পরিস্থিতিতে আগামী কয়েক মাসে আইএমএফ ঘন ঘন বাংলাদেশের অর্থনীতি পর্যালোচনা করবে বলে জানিয়ে দিয়েছে। আইএমএফ বেশ কিছু পরামর্শও দিয়েছে। যেমন, ঋণপ্রবাহের গতি থামানো, ভর্তুকি কমাতে জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধি, বিদ্যুতের মূল্যবৃদ্ধি কার্যকর, সুদ ও বিনিময় হার নির্ধারণে নমনীয়তা বাড়ানো, ব্যাংকিং খাতে সংস্কার জোরদার করা ইত্যাদি। অর্থাৎ অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনায় দক্ষতা দেখাতে না পারলে ভবিষ্যতে আইএমএফের খবরদারিতে দেশকে পড়তে হবে বলেই মনে করছেন সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা।

No comments:

Post a Comment