Tuesday, August 16

সংশোধন নয়, নতুন কোম্পানি আইন হচ্ছে

Alo (August 16, 2011)

বিদ্যমান ১৯৯৪ সালের কোম্পানি আইন সংশোধনের পরিবর্তে নতুন কোম্পানি আইন হচ্ছে দেশে। এ জন্য ‘কোম্পানি আইন সংস্কার কমিটি’ নামে একটি কমিটি গঠন করেছে সরকার।
সম্প্রতি বাণিজ্য মন্ত্রণালয় এক প্রজ্ঞাপন জারি করে ১৭ সদস্যের এ কমিটি গঠন করে। প্রজ্ঞাপনে বলা হয়েছে, বর্তমান বৈশ্বিক পরিস্থিতি বিবেচনায় বিদ্যমান আইন সংশোধন না করে যুগোপযোগী কোম্পানি আইন প্রণয়ন করা করা দরকার।
বাণিজ্যসচিব মো. গোলাম হোসেনকে আহ্বায়ক করে গঠিত এ কমিটির সদস্য-সচিব বাণিজ্য মন্ত্রণালয়েরই যুগ্ম সচিব শওকত আলী ওয়ারেছী।
কার্যপরিধি অনুযায়ী কমিটিকে আগামী অক্টোবরের মধ্যে নতুন কোম্পানি আইনের খসড়া তৈরি করতে হবে। কমিটি প্রয়োজনবোধে আরও বিশেষজ্ঞ সদস্য নিয়োগ করতে (কো-অপ্ট) পারবে এবং বাংলাদেশ ইনভেস্টমেন্ট ক্লাইমেন্ট ফান্ডের (বিআইসিএফ) সহযোগিতা নিতে পারবে।
নতুন কোম্পানি আইন প্রণয়নের সিদ্ধান্ত নেওয়ার আগে অতিরিক্ত বাণিজ্যসচিব এম মর্তুজা রেজা চৌধুরীর নেতৃত্বে সাত সদস্যের আরেকটি কমিটি এ ব্যাপারে ছয় মাস কাজ করে একটি খসড়া তৈরি করে।
ওই খসড়া বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, বিদ্যমান কোম্পানি আইনটি গতানুগতিক, অনাধুনিক এবং অনেক ক্ষেত্রেই প্রয়োগের অযোগ্য। আইনটির বিভিন্ন ধারার মধ্যে অনাবশ্যক দ্বন্দ্ব রয়েছে। শেয়ারবাজারের আইনের সঙ্গেও রয়েছে জটিলতা।
মূলত বাণিজ্য মন্ত্রণালয় বিদ্যমান কোম্পানি আইন, ১৯৯৪-এর সংশোধনের উদ্যোগ নিয়েছিল। কিন্তু সার্বিক বিবেচনায় আইনটি নতুন করে প্রণয়ন করাই যৌক্তিক বলে জানিয়েছেন বাণিজ্যসচিব গোলাম হোসেন।
সূত্র জানায়, নতুন আইন প্রণয়নে প্রতিবেশী দেশগুলোতে প্রচলিত বিধিবিধানকে গুরুত্ব দেওয়া হবে। এ ছাড়া বিবেচনায় রাখা হবে স্থানীয় বাস্তবতার সঙ্গে সংগতি, উন্নয়ন ও আধুনিকায়ন, হয়রানি লাঘব, শেয়ারবাজারের আইনের সঙ্গে সংঘাত এড়ানো, কোম্পানির বার্ষিক সাধারণ সভায় (এজিএম) নৈরাজ্যকর পরিস্থিতির অবসান, রিটার্ন দাখিল সহজতর করা ইত্যাদি।
কোম্পানি-সচিব ও নিরপেক্ষ পরিচালক: জানা গেছে, নতুন আইনে প্রতিটি কোম্পানিতে একজন করে নিরপেক্ষ পরিচালক, কোম্পানি-সচিব ও অভ্যন্তরীণ নিরীক্ষক থাকার ধারা সংযুক্ত হবে, বর্তমানে যা নেই।
পরিশোধিত মূলধনের ক্ষেত্রে প্রতিবেশী দেশগুলোর বিধিবিধান অনুসরণ করা হবে। অর্থা ৎ পরিশোধিত মূলধন দুই কোটি টাকা হলেই কোম্পানির বিধিবদ্ধ সেক্রেটারিয়াল রেকর্ড নিয়মিত নিরীক্ষণ করাতে হবে, মূল্যায়নের জন্য কোম্পানি যা পরবর্তী সময়ে পর্ষদ সভায় উপস্থাপন করবে।
আর পরিশোধিত মূলধন পাঁচ কোটি টাকা হলে কোম্পানিতে সার্বক্ষণিক থাকতে হবে কোম্পানি-সচিব, যাঁরা হবেন ইনস্টিটিউট অব চার্টার্ড সেক্রেটারিজ বাংলাদেশের (আইসিএসবি) সদস্য।
এ ছাড়া কোম্পানিতে নিরপেক্ষ পরিচালক নিয়োগের বাধ্যবাধকতা থাকবে। তবে নিরপেক্ষ পরিচালক হবেন এমন একজন অনির্বাহী পরিচালক, কোম্পানিতে যাঁর কোনো ঋণ বা মালিকানা থাকবে না এবং অর্থ, বাণিজ্য বা আইন বিষয়ে জ্ঞানসম্পন্ন ও সজ্জন ব্যক্তি হিসেবে সমাজে যাঁর সুনাম থাকবে।
গঠনপদ্ধতি: কোম্পানির গঠনপদ্ধতি বিষয়েও নতুন ধারা যুক্ত হবে বলে জানা গেছে। বর্তমানে ‘দুই বা ততোধিক ব্যক্তি’ মিলে প্রাইভেট লিমিটেড কোম্পানি গঠন করতে পারে; পরিবর্তন করে এটা করা হবে ‘এক বা একাধিক ব্যক্তি’। তবে পাবলিক লিমিটেড কোম্পানি গঠনের ক্ষেত্রে বর্তমানের মতো ‘সাত বা ততোধিক’ ব্যক্তিই থাকবেন।
বর্তমানে কোম্পানির সংঘ-স্মারক মুদ্রিত হতে হয় এবং এতে স্বাক্ষরকারী ব্যক্তিদের ঠিকানা ও পরিচয় দুজন সাক্ষীর সামনে স্বাক্ষর করতে হয়। এটি পরিবর্তন করা হবে। পাশাপাশি অনলাইনে সংঘ-স্মারক দাখিল এবং স্বাক্ষর স্ক্যান করার শর্ত জুড়ে দেওয়া হবে নতুন করে।
আর যেকোনো পরিবর্তনের ক্ষেত্রে আদালতের পরিবর্তে ক্ষমতা দেওয়া হবে সরকারকে।
সূত্র জানায়, বিদ্যমান আইনে অনেক ক্ষেত্রেই কোম্পানিকে হাইকোর্টে যেতে হয়। ইংল্যান্ড, সিঙ্গাপুরসহ অনেক দেশই এই রেওয়াজ প্রত্যাহার করে নিয়েছে। বাংলাদেশেও তা প্রত্যাহারের চিন্তা চলছে।
বার্ষিক সাধারণ সভা: সূত্র জানায়, বার্ষিক সাধারণ সভা (এজিএম) বিষয়েও নতুন কিছু শর্তারোপ করা হবে। যে শহরে কোম্পানির কার্যালয় নিবন্ধিত হয়েছে, এজিএম করতে হবে সেই শহরে এবং এজিএমে বা অন্য কোথাও কোম্পানির পক্ষ থেকে শেয়ারধারীদের কোনোরূপ উপহার, উপঢৌকন, নগদ অর্থ বা খাদ্যদ্রব্য দেওয়া যাবে না। তবে হালকা আপ্যায়নের ব্যবস্থা থাকতে পারে।
বর্তমানে কোনো কোম্পানি এজিএম অনুষ্ঠানে ব্যর্থ হলে ওই কোম্পানি এবং কোম্পানির প্রত্যেক কর্মকর্তাকে অনধিক ১০ হাজার টাকা এবং প্রতিদিনের দেরির জন্য ২৫০ টাকা অর্থদণ্ড দেওয়ার বিধান রয়েছে। দণ্ডের টাকার অঙ্ক ৫০ হাজার এবং দেরির জন্য এক হাজার টাকা করা হতে পারে।
এ ছাড়া যেসব প্রাইভেট কোম্পানি ব্যবসা শুরু করার প্রত্যয়নপত্র গ্রহণ করবে না, তারা ব্যবসাই করছে না বলে বিবেচিত হবে। নিবন্ধককে ক্ষমতা দেওয়া হবে যে তিনি তাঁর নিবন্ধন বই থেকে এসব কোম্পানির নাম কেটে দিতে পারবেন।
ডিপোজিটরি আইনের সঙ্গে দ্বন্দ্ব: বিদ্যমান আইনে ‘শেয়ারের প্রকৃতি’ শিরোনামের ধারায় বলা হয়েছে, ‘শেয়ার-মূলধন রয়েছে, এমন কোম্পানির প্রত্যেক শেয়ার যথোপযুক্ত সংখ্যা দ্বারা চিহ্নিত থাকবে।’
বিশ্লেষকেরা বলছেন, শুধু এইটুকু বললে ডিপোজিটরি আইনের সঙ্গে সংঘাত তৈরি হয়। এর সঙ্গে আরও বলতে হবে যে ‘তবে এই ধারা ডিপোজিটরিতে অন্তর্ভুক্ত শেয়ারের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য হবে না।’
বর্তমানে প্রতি কোম্পানিকে ১২ বছরের হিসাব বই ও ভাউচার সংরক্ষণ করতে হয়। যৌথ মূলধনি কোম্পানি ও ফার্মগুলোর পরিদপ্তর (আরজেএসসি) সূত্র জানায়, এই ধারাটি অবাঞ্ছিত, অতিরিক্ত ও একেবারেই অনভিপ্রেত, বরং ছয় বছর পর্যন্ত রাখলেই চলবে।
তবে কোম্পানির পক্ষ থেকে অনলাইনে দাখিল করা যেকোনো দলিল আরজেএসসি সর্বোচ্চ পাঁচ বছর সংরক্ষণ করবে বলে এর আগে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়কে জানিয়েছিল।
সংস্কার কমিটির অন্যরা: আহ্বায়ক ও সদস্য-সচিব ছাড়া আইন সংস্কার কমিটির অন্য সদস্যরা হলেন: ইনস্টিটিউট অব চার্টার্ড অ্যাকাউন্টেন্ট বাংলাদেশের (আইসিএবি) সভাপতি, ইনস্টিটিউট অব কস্ট অ্যান্ড ম্যানেজমেন্ট অ্যাকাউন্টেন্ট বাংলাদেশের (আইসিএমএবি) সভাপতি, বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের ডব্লিউটিও সেলের মহাপরিচালক, সুপ্রিম কোর্ট বার অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি, যৌথ মূলধনি কোম্পানি ও ফার্মগুলোর পরিদপ্তরের নিবন্ধক, আইসিএসবির সভাপতি, বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব লিস্টেড কোম্পানিজের সভাপতি, মেট্রোপলিটন চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির (এমসিসিআই) সভাপতি।
এ ছাড়া আইন মন্ত্রণালয়, আইন কমিশন ও বাংলাদেশ শিল্প ও বণিক সমিতি ফেডারেশনের (এফবিসিসিআই) উপযুক্ত প্রতিনিধি, বাংলাদেশ ব্যাংকের একজন নির্বাহী পরিচালক এবং সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের (এসইসি) একজন সদস্য রয়েছেন এই কমিটিতে।
বক্তব্য: জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) শীর্ষ পর্যায়ের একজন কর্মকর্তা প্রথম আলোকে বলেন, কোম্পানি আইনের অনেক কিছুর দায়ভার আরজেএসসির ওপর। আবার এই প্রতিষ্ঠানটিকে অনেক বাড়তি কাজ করতে হয়, প্রকৃতপক্ষে যা তার কাজ নয়।
উদাহরণ দিয়ে ওই কর্মকর্তা বলেন, রিটার্ন বা করের কোনো বিষয় আরজেএসসি দেখে না; এটি এনবিআরের কাজ। লাভ-ক্ষতির হিসাব, উদ্বৃত্তপত্র ইত্যাদিও এনবিআরের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট। অথচ আরজেএসসিতেও দাখিল করতে হয় এগুলো। নতুন আইনে এ বিষয়ে শৃঙ্খলা আনা দরকার।
যোগাযোগ করলে নিবন্ধক আহমেদুর রহিম প্রথম আলোকে বলেন, আগে সংশোধনের চিন্তা করা হলেও এখন নতুন আইনই করা হবে। কোম্পানি আইনকে যুগোপযোগী করার বিকল্প নেই বলে তিনি মনে করেন।
বাণিজ্যসচিব গোলাম হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, নতুন কোম্পানি আইন প্রণয়ন এখন সময়ের দাবি। বিদ্যমান আইনের দুর্বলতাগুলো তাই পুঙ্খানুপুঙ্খরূপে দেখা হচ্ছে। ইতিমধ্যেই আইনের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সব পক্ষের কাছে মতামত চাওয়া হয়েছে। এ বছরের মধ্যে ব্যবসা-বাণিজ্যবান্ধব ভালো একটি কোম্পানি আইন প্রণয়নের কাজ সম্পন্ন করে যেতে পারবেন বলে তিনি আশাবাদী।

No comments:

Post a Comment