Saturday, August 27

৮৫ ভাগ ওষুধ উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান নিয়ম মানছে না

Alo (August 26, 2011)

দেশের ওষুধ উৎপাদনকারী ১৫১টি প্রতিষ্ঠানের মধ্যে মাত্র ২২টি মানসম্মত ওষুধ উৎপাদন ও বিপণন করছে। বাকিগুলো ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তরের অনুমোদন পেলেও খেয়ালখুশিমতো চলছে। স্বাস্থ্য ও পরিবারকল্যাণ মন্ত্রণালয়-সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটি সম্প্রতি এ ধরনের ৬২টি প্রতিষ্ঠান একেবারে বন্ধ করে দেওয়ার সুপারিশ করেছে।
স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের কাছে দেওয়া সংসদীয় কমিটির প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, নকল, ভেজাল ও নিম্নমানের ওষুধ যেকোনো সময় দেশে ভয়াবহ স্বাস্থ্য-বিপর্যয় ডেকে আনতে পারে। কিন্তু দুর্বল নজরদারির কারণে নিম্নমানের ওষুধ উৎপাদন ও বিপণন বন্ধ করা যাচ্ছে না। ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তর উৎপাদন স্থগিত রেখেছে—এমন কিছু প্রতিষ্ঠানও ওষুধ উৎপাদন ও বিপণন করছে।
স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়-সম্পর্কিত স্থায়ী কমিটির প্রধান শেখ ফজলুল করিম সেলিম বলেন, খেয়ালখুশিমতো চলছে এমন ৬২টি প্রতিষ্ঠান একেবারে বন্ধ করে দেওয়ার সুপারিশ করেছে কমিটি। এর বাইরে কিছু শর্ত মানছে না, এমন ৪১টি প্রতিষ্ঠানকে সংশোধিত হওয়ার শর্ত দেওয়া হয়েছে। বাকি ২৬টি ওষুধ প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠান বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার জিএমপি নীতিমালার কিছু কিছু মেনে চলছে।
বন্ধ করে দেওয়া উচিত এমন প্রতিষ্ঠানের তালিকা কেন প্রকাশ করা হচ্ছে না, এ প্রশ্নের জবাবে শেখ সেলিম বলেন, এতে মানুষের মধ্যে আতঙ্কের সৃষ্টি হতে পারে। আন্তর্জাতিক বাজারে বাংলাদেশের সুনাম ক্ষুণ্ন হতে পারে।
২০০৯ সালের গোড়ার দিকে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার রিড ফার্মাসিউটিক্যালসের প্যারাসিটামল ওষুধ খেয়ে ২৪ শিশু কিডনি বিকল হয়ে মারা যায়। ওই ঘটনার পর স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়-সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটি দেশের ওষুধ শিল্পপ্রতিষ্ঠানগুলোর মান নির্ণয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফার্মেসি অনুষদের ডিন আ ব ম ফারুকের নেতৃত্বে একটি বিশেষজ্ঞ কমিটি গঠন করে। প্রায় দেড় বছর ধরে বাংলাদেশের সব কটি প্রতিষ্ঠান ঘুরে কমিটি প্রতিবেদন পেশ করেছে।
কমিটির প্রধান আ ব ম ফারুক প্রথম আলোকে বলেন, ১৯৮২ ও ২০০৫ সালের ওষুধনীতিতে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার ‘গুড ম্যানুফ্যাকচারিং প্র্যাকটিস’ (উত্তম উৎপাদন কৌশল—জিএমপি) অনুসরণের নির্দেশনা ছিল। কিন্তু অনেক প্রতিষ্ঠানই নিয়মকানুন মানছে না। এই প্রতিষ্ঠানগুলো যেসব ওষুধ উৎপাদন করছে, সেগুলো জনস্বাস্থ্যের জন্য মারাত্মক হুমকি। হয়তো অনেকে এসব ওষুধের কারণে মারাও যাচ্ছে। খতিয়ে দেখা হচ্ছে না।
সুপারিশ বাস্তবায়নের অগ্রগতি সম্পর্কে স্বাস্থ্যসচিব মু. হুমায়ুন কবীর জানান, সংসদীয় কমিটি কিছু সুপারিশ করেছে। এর আলোকে মন্ত্রণালয় যথোপযুক্ত ব্যবস্থা নেবে।
বাংলাদেশ ওষুধ শিল্প সমিতির সাধারণ সম্পাদক আবদুল মুক্তাদির প্রথম আলোকে বলেন, সংগঠন কোনো প্রতিষ্ঠান বন্ধের সুপারিশ করবে না। তবে সংগঠনের পক্ষ থেকে প্রশিক্ষণ দেওয়ার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। এ সুযোগ যেকোনো প্রতিষ্ঠান নিতে পারে।
নীতিমালা মেনে চলছে ২২ প্রতিষ্ঠান: সংসদীয় কমিটি সূত্র জানায়, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার নীতিমালা কঠিনভাবে অনুসরণ করছে ১২টি প্রতিষ্ঠান। এগুলো হলো—স্কয়ার ফার্মাসিউটিক্যালস লিমিটেড (পাবনা ও গাজীপুর), এসিআই লিমিটেড, এসকেএফ বাংলাদেশ লিমিটেড (টঙ্গী), বেক্সিমকো ফার্মাসিউটিক্যালস, বেক্সিমকো ইনফিউশনস লিমিটেড, গ্ল্যাক্সোস্মিথক্লাইন লিমিটেড, ইনসেপ্টা ফার্মাসিউটিক্যালস লিমিটেড, নোভারটিস (বাংলাদেশ) লিমিটেড, রেনাটা লিমিটেড, সানোফি এভেন্টিস লিমিটেড ও স্কয়ার সেফালোসপরিন লিমিটেড।
এই প্রতিষ্ঠানগুলো বিশ্বের ৮৬টি দেশে ওষুধ রপ্তানি করছে এবং দেশীয় বাজারের ৬৭ ভাগ এদের নিয়ন্ত্রণে। শীর্ষ ২০টি প্রতিষ্ঠান নিয়ন্ত্রণ করছে দেশের ৮৫ ভাগ বাজার।
এর বাইরে আরও ১০টি প্রতিষ্ঠান বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার উৎপাদন-কৌশল ‘সন্তোষজনক’ভাবে অনুসরণ করছে। এই প্রতিষ্ঠানগুলো হলো—অ্যাকমি ল্যাবরেটরিজ লিমিটেড, এসকেএফ বাংলাদেশ লিমিটেড (মিরপুর), অ্যারিসটোফার্মা লিমিটেড, বীকন ফার্মাসিউটিক্যালস লিমিটেড, অ্যাসেনসিয়াল ড্রাগস কোম্পানি লিমিটেড (রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠান), বেক্সিমকো ফার্মা (গাজীপুর), অপসোনিন ফার্মা লিমিটেড (বগুড়া রোড, বরিশাল), অরিয়ন ফার্মা লিমিটেড, পপুলার ফার্মাসিউটিক্যালস লিমিটেড ও ইউনিমেড অ্যান্ড ইউনিহেলথ ম্যানুফ্যাকচারার্স লিমিটেড।
দুর্বল অবকাঠামো, অপরিচ্ছন্ন পরিবেশে তৈরি হচ্ছে ওষুধ: সংসদীয় স্থায়ী কমিটি ও বিশেষজ্ঞ দলের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, ১৯৭৬ সালে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা উন্নয়নশীল দেশগুলোর জন্য একটি সহজ নীতিমালা তৈরি করে। তার ভিত্তিতে পরিদর্শক দল কারখানার অবকাঠামো, ওষুধের উৎপাদন ও মান নিয়ন্ত্রণের পদ্ধতি, ডকুমেন্টেশন, উপযুক্ত জনবল, ওষুধ সংরক্ষণ, বিতরণ ও বাজারজাতকরণ প্রণালি, পরিচ্ছন্নতা ও পানির সুবিধা—এই বিষয়গুলোর ওপর ওষুধ উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানগুলোকে এ১ থেকে এফ শ্রেণীভুক্ত করে।
কমিটির মন্তব্য, ডি, ই ও এফ শ্রেণীভুক্ত ৬২টি কারখানা উত্তম উৎপাদন-কৌশল অনুযায়ী অনুমোদনযোগ্য নয় এবং জনস্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর। তাদের সমস্যা প্রচুর এবং তাদের পক্ষে কার্যকর ও নিরাপদ ওষুধ উৎপাদন করা সম্ভব নয়। প্যারাসিটামল সিরাপে ব্যবহূত প্রোপাইলিন গ্লাইকলের পরিবর্তে ভুলক্রমে ডাই ইথালিন গ্লাইকল ব্যবহার করা হলেও তা নির্ণয়ের কোনো ক্ষমতা নেই এদের। এ ছাড়া যে ওষুধে ৫০০ মিলিগ্রাম থাকার কথা, সে ওষুধে আদতে কতটুকু কী আছে, তাও প্রতিষ্ঠানগুলো পরিমাপ করতে পারছে না।
২০০৮ সালে রিড ফার্মার প্যারাসিটামলে ডাই ইথালিন গ্লাইকল মেশানো হয়েছিল। এই রাসায়নিকটি ট্যানারিশিল্প ও গ্লাস তৈরিতে ব্যবহার হয়। ডাই ইথালিন গ্লাইকলের কারণে শিশুদের কিডনি বিকল হয় বলে চিকিৎসকেরা জানান। প্রোপাইলন গ্লাইকলের দাম বেশি হওয়ায় রীড ফার্মা সিরাপে ডাই ইথালিন গ্লাইকল মিশিয়েছিল।
সংসদীয় কমিটি জানায়, নিম্নমানের ওষুধ উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানগুলোয় প্রশিক্ষিত জনবল নেই, থাকলেও সংখ্যায় খুবই কম ও অনিয়মিত। এখানে কাজ করছেন দৈনিক ভিত্তিতে নিয়োজিত শ্রমিকেরা। উত্তম উৎপাদন-কৌশল অনুসরণ করছে—এমন প্রতিষ্ঠানগুলোয় নিজস্ব ডিস্টিলেশন প্লান্ট আছে। এখানে নিয়মিত ভিত্তিতে পানি পরিশোধন-প্রক্রিয়া ও গুণগত মান পরীক্ষা করা হয়।
অন্যদিকে ডি, ই এবং এফ ক্যাটাগরির প্রতিষ্ঠানে ওয়াসার পানি সরাসরি ব্যবহার করা হচ্ছে। এদের তাপ ও আর্দ্রতা নিয়ন্ত্রণ করা যায়—এমন কোনো সুষ্ঠু সংরক্ষণের ব্যবস্থা নেই। যেসব উপকরণ নিয়ন্ত্রিত তাপমাত্রায় (৮-২০ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেড) সংরক্ষণ করতে হয়, সেসব উপকরণ নষ্ট হয়ে যায়।
সংসদীয় কমিটির সভাপতি শেখ ফজলুল করিম সেলিম প্রথম আলোকে বলেন, পরিদর্শনের সময় দেখা গেছে, মানহীন প্রতিষ্ঠানগুলো ওষুধের কাঁচামাল, শ্রমিকের কাপড়চোপড়, বস্তা-কাগজ—সব এক জায়গায় রাখছে। পানি রাখছে বালতি, মগ, বড় পাত্রের মধ্যে। হাতাকাটা গেঞ্জি ও প্যান্ট পরে ওষুধ তৈরি করছেন শ্রমিকেরা। অথচ বিশেষ ধরনের পোশাক পরে ফার্মাসিস্টদের এ কাজ করার কথা।
ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তরের ভূমিকা প্রশ্নবিদ্ধ: বিশেষজ্ঞ কমিটির প্রধান আ ব ম ফারুক বলেন, ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তরের ভূমিকা খতিয়ে দেখা এ কমিটির উদ্দেশ্য ছিল না। তবে পরিদর্শনের সময় তারা দেখেছে, অধিদপ্তর ২৬১টি প্রতিষ্ঠানকে অনুমোদন দিলেও বাস্তবে ১৯৩টি প্রতিষ্ঠান আছে। বাকি প্রতিষ্ঠানগুলোর কোনো অস্তিত্বই নেই।
এদিকে সংসদীয় কমিটি প্রতিবেদনে উল্লেখ করেছে, ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তর বিভিন্ন অভিযোগে সাময়িক লাইসেন্স বাতিল করেছে—এমন কয়েকটি প্রতিষ্ঠানও উৎপাদন চালু রেখেছে। পরিদর্শনের সময় এর প্রমাণ পাওয়া গেছে। তারা পুরোনো ব্যাচ নম্বর ও উৎপাদনের তারিখ ব্যবহার করে ওষুধ তৈরি করছিল।
জিএমপি অনুসরণ করছে না—এমন ৬২টি প্রতিষ্ঠান কী করে অধিদপ্তরের অনুমোদন পেল, জানতে চাইলে অধিদপ্তর কোনো সদুত্তর দিতে পারেনি। অধিদপ্তরের মুখপাত্র সহকারী পরিচালক রুহুল আমিন বলেন, তাঁরা এখন পর্যন্ত এ ধরনের কোনো তালিকা পাননি। অভিযোগ প্রমাণিত হলে এদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

No comments:

Post a Comment